বিভিন্ন স্টেটে ‘স্নো বোম্ব সাইক্লোন’-এর আঘাত: নিউইয়র্কে ইমার্জেন্সি ঘোষণা
প্রবাস রিপোর্ট: আটলান্টিকের উত্তর উপকূল বরাবর মাঝামাঝি নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার উত্তর-পূবাঞ্চলীয় বিশাল এলাকায় এবার ‘স্নো বোম্ব সাইক্লোন’ বা ‘বরফ বোমা ঘূর্ণিঝড়’-এ জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার মানুষ গৃহবন্দি। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, নদী-নালা, সমূদ্র ও নায়েগ্রা জলপ্রপাত সাদা বরফে পরিণত হয়েছে। এমন কি উষ্ণ এলাকা হিসাবে পরিচিত ফ্লোরিডাতেও তীব্র শীত নেমে আসে। সেখানেও কোন কোন স্থানে তুষারপাতের খবর পাওয়া গেছে। ওয়েদার নেটওয়ার্ক-এ দেখা যায় নায়াগ্রা জলপ্রপাতের পানি জমে গিয়েছে।
এদিকে এই পরিস্থিতিতে নিউ্ইয়র্কে ইমাজেন্সী ঘোষনা করেছেন গভর্ণর এন্ড্রু কুমো। একই সাথে মেয়র ডি বাজিও সিটিতে ‘উইনটার ওয়েদার ইমার্জেন্সী’ ঘোষণা করেন।
বুধবার দিবাগত রাত ২টার পর নিউইয়র্ক সিটিতে তুয়ারপাত শুরু হয়। সেই সাথে তীব্র ঝড়। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে তুষারপাত কমে এলেও ঝড় অব্যাহত থাকে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর তাপমাত্রা ভয়াবহভাবে হ্রাস পেতে থাকে। মধ্যরাতে এ তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রী ফারেনহাইট অনুভুত হয়। আমেরিকায় ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় তুষারপাত ও ঘূর্ণিঝড়কে বলা হচ্ছে ‘বরফ বোমা ঘূর্ণিঝড়’।
মেয়র ডি বাজিও এক প্রেস ব্রিফিং-এ তীব্র শৈত্য প্রবাহের কথা জানিয়ে বলেন, শুক্রবার ও শনিবার সিটির তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রী ফারেনহাইট অনুভুত হতে পারে। ফলে এ বিষয়ে তিনি সকলকে সতর্ক হওয়ার আহবান জানান। তিনি শুক্র ও শনিবার খুব প্রয়োজন না হলে সিটিবাসীকে নিজ নিজ বাসায় অবস্থানের অনুরোধ জানান। সেই সাথে এই দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় হোমলেসদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন।
হোমলেসদের জন্য খোলা উষ্ণ আশ্রয় শিবিরগুলো প্রায় শত ভাগ পূর্ণ। প্রায় ছয় হাজার লোক গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এসকল শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছেন। তাপমাত্রা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় টরন্টোয় গৃহহীন ও আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য আরও নতুন নতুন উষ্ণ শিবির খোলার কথা বলা হয়েছে।
সিটির বিভিন্ন স্থানে ১০ থেকে ১৩.৬ ইঞ্চি তুষারপাত রেকর্ড করা হয়েছে। কুইন্সে ও লং আইল্যান্ডের কোথাও কোথাও এই তুষারপাতের পরিমাণ ১৩.৬ ইঞ্চি রেকর্ড করা হয়েছে। ব্রæকলিনে ১১ ইঞ্চি ও সেন্টাল পার্কে ৮ ইঞ্চি তুষারপাত রেকর্ড করা হয়। তবে তুয়ার ঝড়ের বেগ ছিল কোথাও কোথাও ৮০ মাইল।
তীব্র ঝড়, দীর্ঘক্ষন ধরে ঝড় ও শীতল প্রবাহ নগরজীবনকে স্তব্ধ করে দেয়। তীব্র বরফ বোমা ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। এ এক ভীষণ অস্বস্তিদায়ক আবহাওয়া। অধিকাংশ সিটিবাসী খুব প্রযোজন ছাড়া বাসা থেকে বের হননি। নিউইয়র্কে স্কুল-কলেজ বৃহস্পতিবার বন্ধ ঘোষনা করা হয়। সিটির বিভিন্ন ব্যস্ত এলাকায় অধিকাংশ দোকানপাট বন্থ থাকে। এমনকি জ্যাকসন হাইটসের মতো ব্যস্ত এলাকাও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। আপাদমস্তক পশমী মাফলার ও টুপি, চামড়ার দস্তানা, পশমী ওভারকোট, পশমী মোজাসহ ভারী বুট জুতো পরে থাকলেও সবকিছু ভেদ করে ঠান্ডার তীব্রতা। অনাবৃত মুখমÐলে মনে হলো যেন হুল ফুটিয়ে দিচ্ছে হাজার হাজার ভ্রমর। এক মিনিটের বেশি হাঁটতে সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসে।
বোস্টন, ওয়াশিংটনডিসি সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অধিকাংশ এলাকার সকল স্কুল কলেজও বন্ধ ঘোষনা করা হয় খারাপ আবহাওয়ার কারনে।
তীব্র বাতাসে লং আইল্যান্ডে একটি গ্যাস স্টেশনের ছাদ উড়ে যায়। বাতাসের তীব্রতায় সিটির কয়েকটি স্থানে সাবওয়েতে তুয়ার আটকে যাওয়ায় সাবওয়ে ট্রেন চলাচল ব্যহত হয়। এছাড়া জেএফকেসহ বিভিন্ন বিমানবন্তরে হাজার হাজার ফাইট বাহিল করা হয়। সিটির রাস্তায় বাস চলাচল করে তবে তা ছিল কিছুটা অনিয়মিত। বিভিন্ন স্থানে শতশত বাড়ির ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। ফলে তারা এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে সময় অতিবাহিত করেন। এদিকে তুয়ার ঝড়ের ফলে সমুদ্র ইপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় তিন থেকে ৫ ফুট জলোচ্ছাসের খবর জানান হয়।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, তুয়ারপাত বন্ধ হলেও রোববার পর্যন্ত তীব্র শৈত্য প্রবাহ অব্যাহত থাকবে। এসময় তাপমাত্রা ফারেনহাইটেও শুন্যের নীচেই থাকতে পারে বলে তারা আভাস দেন। তবে সোমবার থেকে আবহাওয়া একটু ভালোর দিকে যেতে পারে।
এদিকে তীব্র শৈত্য প্রবাহের কবলে পড়েছে কানাডার পূর্বাঞ্চল, টরন্টোও। বৃহস্পতিবার রাতে সেখানে তাপমাত্রা নামে মাইনাস ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনে রোদ থাকলেও জমে থাকা শুভ্র বরফে রৌদ্রের প্রতিফলন যেন চোখ ঝলসে দেয়। দুপুরের পর থেকে দ্রæত নামে তাপমাত্রা। বিকেল সাড়ে চারটায় তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে অর্থাৎ মাইনাস ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস দেখালেও, বাতাসের শীতলতা নেমে যায় মাইনাস ২৩ ডিগ্রিতে। রাত্রে টরন্টোর তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রিতে নামলেও বাতাসের শীতলতা নামবে মাইনাস ৩৩ ডিগ্রিতে। এই অবস্থা থাকবে সকাল অবধি। তাপমাত্রার সামান্য উন্নতি হবে শুক্রবার বিকেল নাগাদ। তবে একই রকম পরিস্থিতি থাকবে আগামী রোববার পর্যন্ত।
শীতকালীন ঝড়ে বিপর্যস্ত ইউরোপ
এদিকে পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউরোপজুড়ে আঘাত হানা শীতকালীন ঝড়ে অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ডসহ অঞ্চলটির বিভিন্ন দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, ঝড়ের কারণে লাখো মানুষ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ব্যাহত হচ্ছে বিমান চলাচল। প্রতিবেদনে বলা হয়, আল্পস পর্বতমালার ফরাসি অংশে গাছ পড়ে একজন নিহত হয়েছে। স্পেনের উত্তরাঞ্চলীয় বাসকিউ উপকূলে বিশাল ঢেউয়ের টানে দুইজন ডুবে যায়। আমস্টার্ডামের বিমানবন্দরে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটারেরও বেশি বেগে জড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। সেখানে কয়েকশো ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। ফ্রান্সে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৪৭ কিলোমিটার। দেশটিতে ঝড়ের কারণে ১৫ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর। ঝড়ো বাতাসের কারণে আইফেল টাইয়ার বন্ধ রাখা হয়েছে। গাছ উপড়ে পড়ার ভয়ে পার্কগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে ঝড়ের সময় একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে আটজন আহত হয়েছে। দেশটির প্রায় ১৪ হাজার ঘরবাড়ি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুইজারল্যান্ডে একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটারের বেশি বেগে বয়ে যাওয়া ঝড়ো হাওয়ার কারণে পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সুইজারল্যান্ডেও ঝড়ের প্রভাবে প্রায় ১৪ হাজার বাড়ি বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে এবং একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে কয়েকজন আহত হয়েছে। সুইডেনে লুসানে শহরের কাছে ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৯৫ কিলোমিটার রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। বেলজিয়ামে ঝড়ের সতর্কতা জারি করে লোকজনকে সাবধানে চলাফেরা করতে বলা হয়েছে। ঝড়ের কবলে পড়া যুক্তরাজ্যের হাজার হাজার ঘরবাড়ি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বেলজিয়ামে চারটি সতর্কতা মাত্রার মধ্যে তৃতীয়টি অর্থাৎ ‘অরেঞ্জ’ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। লোকজনকে সাবধানে চলাচলের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অস্ট্রিয়া ও জার্মানির কিছু অংশেও ঝড় আঘাত হেনেছে। অস্ট্রিয়ার কিটজবুহেল থেকে একটি ক্যাবল কারে আটকা পড়া ২০ আরোহীকে উদ্ধার করা হয়েছে।